গল্পঃ ভালোবাসার সাত রঙ (১ ও ২)

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৪ আগস্ট, ২০১৪, ০৬:২৫:২৬ সন্ধ্যা

[ তিন পর্বে লেখা 'ভালবাসার সাত রঙ' গল্পটির প্রথম দুটি পর্ব আজ পোষ্ট করলাম]



এক.

সখি বয়ে গেল বেলা...

পাহাড়ের (আসলে মাটির টিলা) যেখানটিতে আমি বসে আছি, তার চারিদিকে হাজারো অচেনা শব্দ এক সাথে ভেসে আসছে। কিন্তু তারপরও এক অভাবনীয় নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। ঘরে ফেরা পাখীদের ডাক, বুনো প্রান্তরের লুক্কায়িত কীট-পতঙ্গের আওয়াজ-এ সবকিছুকে ছাপিয়ে সমুদ্রের গর্জন আর সামুদ্রিক বাতাস ঝাউবনের ভিতর দিয়ে যাবার শো শো শব্দ... আমার চেতনাকে ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছে।

হীমছড়ির এই টিলাগুলোর সাথে, আদিগন্ত বিস্তৃত ঐ সমুদ্র এবং ওর বেলাভূমি- এসবের সাথে আমার সেই ছেলেবেলা থেকে গভীর সম্পর্ক। এখানেই আমার জন্ম এবং স্কুল জীবনটা এখানেই কাটিয়েছি। কলেজ এবং ভার্সিটির সময়টা চাটগাঁতে।

'ও'র গ্রামের বাড়ীও এই কাছে।

তবে ভার্সিটিতেই ওর সাথে পরিচয়। পরিচয় থেকে জানাশোনা, বন্ধুত্ব এবং... এবং প্রেম? আসলে একে প্রেম বলা যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে। আসলে ওকে বোঝাটাই খুব টাফ। ভীষণ মুডি মেয়ে। চির-চঞ্চলা হরিনী যেন! মনের গতিবিধি মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়। আগাম কোনো পুর্বাভাষ দেবার নিয়মই নেই যেন ওর অভিধানে।

এমন এক 'ও'কে ভালবাসলাম।

নাম নাইবা জানালাম।

বললেও কি তোমরা চিনবে?

দু'বছর ধরে ওর সাথে ছায়ায়-কায়ায় মিলে মিশে আছি।

এখনো পর্যন্ত শুধু ওর ডান হাত ধরতে পেরেছি। তাও কয়েক মুহুর্তের জন্য। যখনই হাতে হাত রেখে কিছু আবেগী মুহুর্তকে স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাই দেবার ইচ্ছে পোষণ করেছি, কোনো না কোনো এক অনিচ্ছাকৃত পুর্ব ভুলের ফিরিস্তি অতীতের রথে করে সে নিয়ে এসেছে। আর তারপর আমার হাতকে 'ডিটেনশনে' পাঠানো হয় বেশ কিছুদিনের জন্য।

এরকম একজনকে নিয়ে আমার স্বপ্নের জাল বোনা হয়তো সেই কবেই বন্ধ হয়ে যেত। যদি না...

যদি না নিজের অপারগ দিল একটু বেশীই ওর জন্য কেমন দুর্বল হয়ে পড়ত। আর আমার সাথে ঝগড়ার সময়ে তীব্র উত্তেজনায় ওর নাকের নীচের বিন্দু বিন্দু জলকনা যা আলোকরশ্মির প্রতিফলনে আমার হার্টবীটকে আরো দ্রুততর করে দেয়। সামান্য চাহনি-ভ্রুকুটি অথবা রাগে চীৎকার করে আমাকে গালিগালাজের সাথে চিতার হিংস্রতায় নখের বিদীর্নকরণ... এসব কিছু মিলিয়েই আমি ওর জন্য পাগল।

ও যা করে আমি তাতেই মুগ্ধ হই!

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওর মনের মুগ্ধতার দৃষ্টির ত্রি-সীমানায় নিজেকে কখনো দাঁড় করাতে পারি নাই! আসলে ওর ভালবাসার যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয়তো আমি ফেল করেছি।

হয়ত কেন, অবশ্যই করেছি।

ফ্লাক্স থেকে এক ঢোক চা খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ আগে কোকের বোতলে লুকিয়ে থাকা রেন পুল্যাক কোম্পানির কফ সিরাপ অনেকটা খেয়েছি। পরে কয়েক কাপ দুধ চা আর সিগ্রেটে ভরা গাঁজা টানাতে সারা শরীরে চিনচিনে এক অসম ভাললাগার অনুভুতি! এজন্যই মনে হয়েছিল চেতনা ফ্রেমে বন্দী হয়ে আছে যেন।

বেলাভূমিতে কয়েকজন উচ্ছল তরুন-তরুনী মন্থর হেঁটে হেঁটে জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মিলাচ্ছে।

অথচ আমি নিজে এই টিলার উপরে একজন 'সলিটারি লাভার' হয়ে ত্রি-ফলা নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছি।

বুকের ভিতরের জমাট বাঁধা কিছু আক্ষেপকে উড়িয়ে নিয়ে দূর সমদ্রে ফেলে দিয়ে এলো সামুদ্রিক বাতাস। তবে ফিরতি পথে সাথে করে নিয়ে এলো আরো অনেক বেশী তরল কষ্টকে... যা শিরায় শিরায় রক্তের নাচনকে উদ্বেলিত করবে মুহুর্মুহু!

... ...



দুই.

অস্ত রবির ছবির সনে মিলবে আয়োজন...

হিটলারের নাৎসি সেনাদের মতো লাইন ধরে মার্চ করে চলেছে লাল কাঁকড়ার দল।

সবার পিছনে সাদা শার্ট ও ব্লু জীনস পড়ে ওদের পিছু পিছু আরো একজন মুগ্ধ হয়ে অনুসরণ করছে। ছোট ছোট লাল রঙের এই কীটগুলো পুরো সমুদ্র সৈকতকে একেবারে লাল করে রেখেছে। সাদা ফেনার নীল সমুদ্রের পাড়ে চিকচিকে বালির উপরে চলন্ত লালের এই কম্বিনেশন!

ওয়াও! চমৎকার!!

পড়ন্ত বিকেলের মোলায়েম রোদ বাতাসের ছোঁয়ায় আরো তাপ হারিয়ে শরীর-মন দুইকেই প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। মেয়েটি কাকড়াগুলোকে অনুসরণ করে অনেক দূরে চলে এসেছে। ওর মটর বাইকটি রাস্তার পাশে যেখানে রেখে এসেছে, সেটা এখান থেকে প্রায় চার পাচশ' গজ তো হবেই।

এই মেয়েটিই পাহাড়ের উপরে একা বসে থাকা সেই 'সলিটারি লাভার' বয় এর 'লাভার গার্ল'।

সে এতটা সুন্দর... মোহনীয় এবং নরম যে সকলের পরম আরাধ্য! ওর উপরের ঠোঁটের সামান্য ওপরে একটি তিল... এই বিঊটি স্পটটি তাঁর চেহারা আরো আকর্ষনীয় করেছে। অন্যরা যখন তাঁকে দেখে, চোখ-ঠোঁট হয়ে তাঁদের দৃষ্টি ঐ তিলের উপরে নিবিষ্ট হয়। আর কেন জানি তাঁদের হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে ওখানে কামড়ে দেবার দুষ্ট ইচ্ছেটা জেগে উঠে।

যদি কোনোভাবে এই 'লাভার গার্ল' ওদের মনের খবর জানত। তবে একেবারে খবর করে ছেড়ে দিত। এমনই বেপরোয়া মেয়ে সে।

টেকনাফে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ করছে এমন একটি বেসরকারী সংস্থায় জব করে। নিজেই মটর বাইক ড্রাইভ করে প্রতিদিন যাওয়া আসা করে। কক্সবাজারের মেয়ে সে। এই সাগর পাড়ের আলো-বাতাস ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং সকল প্রতিকূলতার ভিতর দিয়েই বড় হয়েছে। শখের বশে হলেও আন-আর্মড কম্ব্যাটে ব্ল্যাক বেল্টধারী। কালো দীঘল কোঁকড়ানো চুল আর কমনীয় মুখশ্রী বাদে আর সব কিছুই কেমন যেন রুক্ষতায় ভরা। ওকে এই মুহুর্তে দেখলে মনে হবে, সাদা আর নীলে আবৃতা এক কালোকেশী লাল কাঁকড়ার পিছু ধেয়ে ধেয়ে অস্তগামী সুর্যের রক্তিম আভা হৃদয়ে ধারণে ব্যতিব্যস্ত এক সাগরকন্যা! যে কিনা আপাদমস্তক রুক্ষতার খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখে... তবে খুব সুন্দর এবং সাগরসম ভালোবাসা নিয়ে এই খোলসের ভিতরেই একটি হৃদয় লুকিয়ে আছে যা কেউ জানতে পারে না।

রুক্ষ হৃদয়ের ভিতরে অন্য এক কোমল হৃদয়!

হৃদয় মাঝে আর এক হৃদয়!

সে জানতে দিতে ও চায় না কাউকে।

শুধুমাত্র একজনকে ছাড়া...

যে ঐ টিলাগুলোর যে কোনো একটির উপরে বসে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আর এই মুহুর্তে ঠিক ওকে নিয়েই ভাবছে।

ভাবছে... চিন্তার জাল বুনছে। কিন্তু ওটা ঐ চিন্তার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

তার সামনে এলেই সে কেমন করে যেন বোবা প্রানীতে পরিণত হয়।

ইচ্ছে আছে কিন্তু সাহসে কুলায় না।

মেয়েটি ফিরতি পথ ধরে বাইকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

ধীরে ধীরে ওর আর স্লথ গতিবেগের সেই লাল বাহিনীর মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।

ভাবে, সেও কি 'লাভার বয়' এর সাথে একটু বেশীই রুক্ষ ব্যবহার করছে না? ওদের মাঝের এই দেয়াল তো তাঁর নিজেরই তৈরী করা? সে কেন 'ও'কে নিজের বেশী কাছে আসতে দিতে চায় না।

পরক্ষনেই চোয়াল দৃঢ় হয়।

না, 'লাভার বয়' ললিপপ টাইপের হোক তা সে চায় না। ওকে একজন সত্যিকারের পুরুষে রূপ দেবার জন্যই তো ওর এই খোলস ধারণ করা। না হলে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে কোনো এক বৃষ্টির রাতে বিছানায় জড় পদার্থের মত পড়ে থেকে ওর ও তো মন চায় 'সে' আসুক। এসে শুধু ডান হাত নয়, শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে ভালবাসার আগুন জ্বালিয়ে যাক!

নিজেকে 'লাভার বয়' এর হাতে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করতে এক ভীরু পাখির মত অসহায় হয়ে অপেক্ষা করে সে।

হৃদয়ের ভিতরে ঝড় বয়ে যায়... প্রতিটি রোমকূপ তৃষ্ণায় জেগে উঠে... একসময় অতৃপ্তির মাঝে লীন হতে হতে আবার সেগুলো নিস্তেজ হয়।

এভাবেই রাত ভোর হয়... দিন থেকে সন্ধ্যা... রাত... আবার ভোর।

জীবন কেটে যায় পা পা করে।

বলাকারা ফিরে যাচ্ছে... বেলাশেষে ভানুও নিজেকে অস্তগামী করাতে ব্যস্ত। এরি মাঝে রহস্যময় এক রাত নামবে। গৃবা উঁচু করে হেঁটে যাওয়া এক এলোকেশীর জীবনে সেটা নতুন কোনো কিছু এনে দিবে কি?

পাহাড়ের উপরে বসেই 'লাভার বয়' তাঁর 'ও'কে বাইক চালিয়ে চলে যেতে দেখে। সামুদ্রিক বাতাসের উপরে তাঁর প্রচন্ড হিংসে হয় এই মুহুর্তে। 'ও'র চুলগুলোকে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলা করছে বাতাস! যা সে অনেক চেয়েও একটু ছুঁয়ে দেখতে পারেনি!

মোবাইল হাতে নিয়ে 'ও'র নাম্বারটি বের করে।

কিন্তু কল করা হয়না...

হয় না মনের না বলা কথাগুলো তাঁকে বলা।

যদিও প্রকৃতি আজ তাঁদের দুজনের জন্য সব আয়োজনই করে রেখেছিল!! Rose

বিষয়: সাহিত্য

১৯১৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

257846
২৪ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৮:১৮
আতিক খান লিখেছেন : চমৎকার লেখা। ৩য় পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম Rose Day Dreaming Good Luck
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:৫৫
201635
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ অনেক অনেক... শুভেচ্ছা রইলো। অপেক্ষার জন্য আরো একবার ধন্যবাদ। Happy Good Luck
257895
২৪ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৩৮
আজিম বিন মামুন লিখেছেন : বলতে লজ্জা নেই কলেজে থাকাকালীন প্রচুর শরৎ/সমরেশ/সুনীল সারারাতও পড়েছি।এখন পড়িনা কেন জানেন?এসব পড়লে না আমার কী যেন হয়,দূর থেকে যেন কারও ডাক শুনতে পাই।সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ী থেকে পালিয়েছি বহুবার।
আজ আপনার লেখাটা পড়ে বুকের ভেতর টা কেমন হু হু করে উঠল।লাভার বয়ের হয়ে আমিই একটু কষ্ট পেলাম।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ একটু বিলাসী দুঃখের ঠিকানা দেবার জন্য।শুভকামনা।
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:৫৭
201636
মামুন লিখেছেন : আপনার কমেন্টটি অপুর্ব এক সুখানুভূতির দোলায় মনকে আন্দোলিত করে গেলো। অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো। ভালো থাকবেন... সবসময়।Good Luck Good Luck
257986
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:০৬
কাহাফ লিখেছেন : "নিস্তব্ধতার বেড়ি বাধে আছড়ে পড়ে সরবের শীর্ণকায় স্রোত ধারা,বলা হয়না কিছুই.........।" Good Luck Good Luck Good Luck
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:৫৮
201637
মামুন লিখেছেন : "..যে কথা বলা হয়নি তারে, সে ভাষা কেন ফিরে আঁখিরও দ্বারে..." ধন্যবাদ নান্দনিক মন্তব্যের জন্য।Good Luck
258003
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৩০
কাহাফ লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ,সুস্হ্যতা কামনা করি আপনার। Rose Rose Rose Rose
২৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৩৭
201646
মামুন লিখেছেন : আপনিও ভালো থাকবেন।Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File